প্রায় চার মাস ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রম বন্ধ। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায়ও জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনে ভোগান্তির অন্ত নেই।
শুক্রবার (৬ সেপ্টেম্বর) জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন দিবসের অনুষ্ঠানে মন্ত্রীর উপস্থিতিতেই এই ভোগান্তির জন্য নাগরিকদের ‘গালি’ শুনতে হয় বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ঢাকা উত্তরের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় জন্মনিবন্ধন করতে গিয়ে ভোগান্তির শিকার হয়ে সরকারের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তা নিয়ে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলামকে ফোন করার কথা নিজেই জানিয়েছেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেছেন, ৬৪ জেলা থেকে প্রতিদিনই জন্ম-মৃত্যুর নিবন্ধন নিয়ে অভিযোগ পাওয়া যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত এক বছরে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনভুক্ত এলাকায় ভোগান্তি ছাড়া জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন করতে পেরেছেন এমন লোকের দেখা পাওয়াই দুষ্কর। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সরকারের উচ্চ মহলের লোকজনও এই একটা কাজে গিয়ে আটকে যাচ্ছেন। শিকার হচ্ছেন নানা ভোগান্তির। বিষয়টি কেবল এই এলাকাতেই সীমাবদ্ধ নেই। সারা দেশেই জন্ম ও মৃত্যুর নিবন্ধনে প্রায় একই চিত্র। এরপরও জাতীয় জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন দিবসে এ কার্যক্রমে ‘কৃতিত্বের’ জন্য দেখা গেছে পুরস্কারের ছড়াছড়ি! পুরস্কার ও সম্মাননার বহর দেখে খোদ সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যেও এ নিয়ে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়।
শুক্রবার (০৬ অক্টোবর) রাজধানীর একটি হোটেলে ঘটা করে ২৪ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। সেই সুবাদে জানা গেছে, জন্ম-মৃত্যুর নিবন্ধন কার্যক্রমে ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে প্রথম স্থান অর্জন করেছে ডিএনসিসি। এ ছাড়া ডিএসসিসি দ্বিতীয় ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন তৃতীয় স্থান অর্জন করেছে। পৌরসভা ক্যাটাগরিতে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও যশোর পৌরসভাকে।
এ কার্যক্রমের জন্য ১০টি ইউনিয়ন পরিষদকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। এগুলো হলো- কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা, পাবনার দোগাছী, ভাঁড়ারা ও হেমায়েতপুর; সাভারের ধামসোনা, সিরাজগঞ্জের দৌলতপুর, পোরজনা ও খুকনী; মুন্সীগঞ্জের পঞ্চসার এবং নোয়াখালীর চরজব্বার ইউনিয়ন পরিষদ। এ কার্যক্রমের জন্য পুরস্কার পেয়েছে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড। তা ছাড়া সর্বোচ্চ জন্মনিবন্ধনের জন্য দুবাইয়ে বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল এবং ডেটা শুদ্ধতার জন্য সিঙ্গাপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনকে সম্মাননা দেওয়া হয়েছে।
নিবন্ধনকর্মের স্বীকৃতি হিসেবে সিরাজগঞ্জের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক মোহাম্মদ তোফাজ্জল হোসেন, পাবনার স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক মো. সাইফুর রহমান এবং নোয়াখালীর স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক মো. আবু ইউসুফ পুরস্কার পেয়েছেন।
পুরস্কার বিতরণের আগেই ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম জন্মনিবন্ধন কার্যক্রমে ভোগান্তি উষ্মা প্রকাশ করেন। পুরস্কার ঘোষণার সময় ঢাকার বাইরে থেকে আসা একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘মেয়র বললেন- মানুষ গালি দেয়, তাহলে পুরস্কার দিল কীভাবে।’ এ সময় উপস্থিত অনেকেই এ নিয়ে কথা বলেন।
অনুষ্ঠান শেষে এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কার্যালয়ের রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. রাশেদুল হাসান বলেন, সিটি করপোরেশন কাজ করে না, তাই মানুষের ভোগান্তি হয়। কাজ না করার পরও পুরস্কার কীভাবে পেল- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গত বছরের জুলাই মাস থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত কাজের পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। শিশুদের জন্মনিবন্ধন যারা বেশি করেছে তাদের (সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন) পুরস্কৃত করা হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতে দূতাবাস ভালো করেছে, সিঙ্গাপুরে কম হলেও পিওর কাজ হয়েছে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে রেজিস্ট্রার জেনারেলকে উদ্দেশ করে ডিএনসিসির মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন ‘পাসওয়ার্ড দিয়ে ক্লিক করলে কিছু আসে না। গালি খেতে হয় আমাদের। আপনার ফোন নম্বর দিয়ে দেন। ১০ জনের ফোন নম্বর পেপারে দিয়ে দেন। লিখে দেন, জন্মনিবন্ধনে সমস্যা হলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। দেখেন কত ফোন আসে, কত গালি খান। আমারও সহ্যের সীমা আছে। মনের দুঃখ থেকে কথাগুলো বলছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যে গালি শুনছি, সেটা যদি পাল্লায় রাখি তার লোড নিতে পারবেন না। না আমরা নিতে পারব, না সরকার নিতে পারবে। এ সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে চায়। এভাবে চললে কীভাবে হবে? সমস্যার সমাধান করুন।’
ডিএনসিসির মেয়র এ সময় বলেন, ‘মানুষের ভোগান্তি কিন্তু বদদোয়া। একটি মেয়ে গতকাল মিরপুরে কীভাবে কেঁদেছে, আমি মন্ত্রীকে বলেছি। গ্লাসের পানি অর্ধেক আছে, অর্ধেক নাই। লোকবল, টেকনিক্যাল দিক সব সমাধান করুন। যেখানে সরকারের ইমেজ নির্ভর করে, সেখানে লোকবল সংকট থাকবে কেন?’
আতিকুল ইসলামের সঙ্গে একমত পোষণ করে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, ‘মেয়র আতিক সাহেব যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার সঙ্গে আমার কোনো দ্বিমত নেই। একজন মানুষও ভোগান্তিতে পড়লে তা আমাদের দেখতে হবে। রাস্তাঘাট হচ্ছে, কমিউনিটি সেন্টার হচ্ছে, সব উন্নত হচ্ছে। তাহলে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনে ভোগান্তি থাকবে কেন?’
এ সময় রেজিস্ট্রার জেনারেলকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘ডিজি সাহেব, আপনাকে স্পষ্ট করে বলতে হবে কোথায় কোথায় সমস্যা আছে। আজ এখানে তিক্ত কথা হয়েছে। তিক্ত কথায় সমস্যা সমাধানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এটা ভালো হয়েছে।’
সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মীদের রাতেও কাজ করার পরামর্শ দিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘অনেক সময় একটু বেশি কাজ করা লাগে। আমরাও অনেক সময় রাতে কাজ করি। পিক টাইমে সার্ভারে ব্যস্ততা থাকে।’
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন রেজিস্ট্রার জেনারেল রাশেদুল হাসান। অনুষ্ঠান শেষে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কিছু হলেই সার্ভার ডাউনের দোহাই দেওয়া হয়। সার্ভারে বড় ধরনের কোনো সমস্যা নেই। সার্ভার ঠিক আছে। সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা/৫টা পর্যন্ত পিক আওয়ার, তখন একটু স্লো হয়। মাঝেমধ্যে সমস্যার কারণে সার্ভার ঠিক করতে হয়। তখন নোটিস দিয়ে দিই। সিটি করপোরেশন ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। তাদের কর্মীরা পাসওয়ার্ড ভুলে যায়। ডিএনসিসিতে জন্মনিবন্ধন হচ্ছে না বলে অভিযোগ আসার পর আমরা পাসওয়ার্ড, ইউজার আইডি মোবাইলে পাঠিয়েছি। পরে কাজ হয়েছে। তারা (সিটি করপোরেশন) কাজ করে না। ঢাকা দক্ষিণ সিটি তো আসেই না।’
জাতীয় জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন দিবস উপলক্ষে স্থানীয় সরকার বিভাগ এ অনুষ্ঠান আয়োজন করে। সচিব মো. ইব্রাহিমের সভাপতিত্বে সভায় আরও বক্তব্য দেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব মো. সামসুল আরেফিন, ইউনিসেফের চিফ অব চাইল্ড প্রটেকশন মিস নাটালি ম্যাককলি প্রমুখ।
জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন ডিজিটাল করার পর থেকে যেন আরও বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন সাধারণ মানুষ। মাসের পর মাস ঘুরেও জন্মনিবন্ধন করাতে পারছেন না তারা। এমনকি ঘুষ দিয়েও কাজ করানো কঠিন হয়ে পড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ভুক্তভোগীদের অনেকেই। তাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে জন্মনিবন্ধনের জন্য দপ্তরে দপ্তরে ঘুরতে হচ্ছে। সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদে আবেদন করে তা নিয়ে আবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) অফিস হয়ে ছুটতে হয় জেলা প্রশাসক (ডিসি) কার্যালয় পর্যন্ত। এরপরও মেলে না কাঙ্ক্ষিত সনদ।
তাদের অভিযোগ, সেবা সহজ করতে অনলাইনে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু করে সরকার। সার্ভারের ধীরগতি, নিবন্ধন ও ভুল সংশোধন পদ্ধতি জটিল করায় সে সেবা সহজে মিলছে না।
জানা গেছে, মিরপুর ১০-এর বাসিন্দা রনি আহমেদের ছেলের স্কুলে ভর্তির আবেদনের সঙ্গে জন্মনিবন্ধন সনদ চাওয়া হয়েছে। সেই সনদ নিতে তিনি যান ডিএনসিসির আঞ্চলিক অফিসে। কিন্তু কর্মকর্তারা জানান, ছেলের জন্মনিবন্ধনের আগে বাবা-মায়ের ডিজিটাল জন্মনিবন্ধন লাগবে। কথা প্রসঙ্গে রনি বলেন, ‘আমার ও আমার স্ত্রীর আগের জন্মনিবন্ধন ছিল। কিন্তু এগুলোতে কাজ হচ্ছে না। আবার নতুন করে ডিজিটাল করতে বলেছে। কিন্তু সার্ভার জটিলতায় আমাদেরটারও কাজ শুরু করতে পারিনি। ফলে ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করাতে গিয়ে বিপাকে পড়েছি। এখন গ্রাম থেকে জন্মনিবন্ধন করাব ভাবছি। কিন্তু শুনেছি ওখানেও একই অবস্থা।’
আরেকটি ঘটনা থেকে জানা যায়, ডিজিটাল জন্মনিবন্ধনে নামের বানান ভুল থাকার কারণে ২৪ বছর বয়সেও ভোটার হতে পারছেন না ফারজানা আক্তার। তাই নাম সংশোধনের জন্য যান ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার উথুরা ইউনিয়ন পরিষদে। কয়েক মাস ঘুরেও ব্যর্থ হন। পরে তার কাছে ঘুষ চাওয়া হয়। তবে ঘুষ দিলেই যে কাজ হয়ে যাচ্ছে এমনও নয়। অনেকেই অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন।